ঢাকা, ২৭ নভেম্বর বুধবার, ২০২৪ || ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
৯৬২

দেশীয় চলচ্চিত্র ২০১৯: বছরজুড়ে চেষ্টা ছিল গল্প বলার 

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ১২:০৫ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯  

ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। কখনো গল্পের অভাব কখনো বা বাণিজ্যিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার অভিযোগ। চলতি বছর ব্যবসার দিক থেকে খুব একটা লাভবান হয়নি বলে আক্ষেপ রয়েছে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের। তবে এসব অভিযোগের মাঝেও এ বছর বেশকিছু ছবি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য আশা এবং নির্মাতাদের জন্য ভবিষ্যত্ সম্ভাবনার পথ তৈরির চেষ্টা করেছে। ২০১৯-এ মুক্তি পাওয়া কয়েকটি ছবির অন্যতম বিশেষত্ব ছিল— ছবির গল্প। এ ছবিগুলোয় ভিন্নধর্মী গল্পের প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। এ কারণেই  ফাগুন হাওয়ায়, হূদয়ের রংধনু, যদি একদিন, লাইভ ফ্রম ঢাকা, আলফা, আবার বসন্ত-এর মতো ছবিগুলো এ বছর আলোচনায় ছিল। 

২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছে ৪১টির মতো ছবি। সর্বশেষ মায়া: দ্য লস্ট মাদার দিয়েই মূলত ’১৯-এর ইতি টানা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ফাগুন হাওয়ায় চলচ্চিত্রটি। ছবিটিতে ভাষা আন্দোলনের সময় এক মফস্বল শহরের মানুষের ভাবনা, আন্দোলন আর চেতনাকে রূপক অর্থে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। ছবিটির মাধ্যমে তৌকীর দর্শকদের নিয়ে যান প্রায় ৬৭ বছর পেছনে। মনে করিয়ে দেন ভাষা আন্দোলনের সময়কার স্মৃতি। মুক্তির আগে ফাগুন হাওয়ায় নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হয়। মুক্তির পর ছবিটি দর্শকের মনে কতটা স্থান করে নিতে পেরেছে, তা বুঝতে ৭০ বছর বয়সী সৈয়দা ফাতেমা তুজ জোহরা নামের একজন দর্শকের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। ছবিটি মুক্তির পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি ফাগুন হাওয়ায় দেখতে আসেন। ছবিটি দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তার ভাষায় এ ছবি নাকি তাকে ’৫২-এর অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে।

একই মাসে মুক্তি পায় হূদয়ের রংধনু। ভিন্নধর্মী ছবিটি পরিচালনা করেন রাজীবুল হোসেন। এক নিরুদ্দেশ যাত্রা ও রহস্যজনক ফোন কলে পাল্টে যায় চার যুবক-যুবতীর জীবন। ক্লু খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় এক নতুন বাংলাদেশ—ছবির গল্প এ রকমই। ছবিটি গ্লোবাল তাজ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সেরা সিনেমাটোগ্রাফির পুরস্কার জিতে নেয়। এছাড়া ২০১৮ সালে ছবিটি গোয়া ফিল্ম বাজারের ভিউ কর্নারে নির্বাচিত হয়। অবশ্য ছবিটি দেশের একটিমাত্র প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল।

অগ্নিঝরা মার্চে মুক্তি পায় সাদা-কালো ছবি লাইভ ফ্রম ঢাকা। ঢাকা শহরে জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া এক যুবকের বারবার হোঁচট খাওয়ার গল্প নিয়ে এ ছবি। আমাদের আটপৌরে জীবনের গল্পকেই যেন ছবিতে রূপ দেন তরুণ নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ‘ভালো ছবি’ বলতে যা বোঝায়, লাইভ ফ্রম ঢাকা ছিল সে রকমই একটি। বাণিজ্যিকভাবে ছবিটি ততটা সফল না হলেও চলচ্চিত্রে গল্পের প্রবল খরার মধ্যে ছবিটি বেশ আশার সঞ্চার করেছিল। ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে অংশগ্রহণ এবং পুরস্কার প্রাপ্তিই যেন সে কথা প্রমাণ করে। চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক-সমালোচকদের ভাষ্য, শুধু গল্প নয়, ছবিটি নির্মাণেও একেবারে নবীন এ পরিচালক যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের মাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মাত্র এক সপ্তাহ চলার সুযোগ পেয়েছিল। তবে আশার কথা, ছবিটি যেন আরো বেশি সময় ধরে প্রেক্ষাগৃহে চলতে পারে, সে দাবি করেছিলেন ঢাকার স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠকদের অনেকে। এমনকি এক সপ্তাহ চলার পর একটি প্রেক্ষাগৃহ ছবিটি প্রত্যাহার করে নেয়ায় তারা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন পর্যন্ত করেছিলেন।


এপ্রিলে মুক্তি পায় আলফা। চলচ্চিত্রটিতে যান্ত্রিক শহর ঢাকার বাস্তবতার সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে একজন রিকশাচালকের বেঁচে থাকার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। মুক্তির পর ছবিটি বেশ প্রশংসিত হয়। আলফাকে অস্কারের ৯২তম আসরে প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত অস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা পায়নি এটি।

অসম প্রেমের গল্পে আবর্তিত অনন্য মামুন পরিচালিত আবার বসন্ত। ছবিটি মুক্তি পায় জুনে। আগের ছবিগুলোর মতোই গল্পের বিশেষত্বের জোরে এটিও দর্শকের মনে স্থান করে নেয়।

ভালো গল্প ও ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের তালিকায় মায়াবতী-র নামটি চলে আসে। এতে নারী পাচার ও একটি মেয়ের সংগ্রামী জীবনের গল্পের পাশাপাশি সমাজের পারিপার্শ্বিক নানা অবস্থা চিত্রিত করেন নির্মাতা অরুণ চৌধুরী। গল্প আর নির্মাণশৈলীর কারণে ছবিটি দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়। মায়াবতী তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য অনুপ্রেরণার বলেও তখন রায় দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা। ছবিটি দেশের বাইরেও অনেক জায়গায় প্রদর্শিত হয়।

এ বছর ইতি, তোমারই ঢাকা নিয়েও বেশ আলোচনা হয়। দেশের চলচ্চিত্র প্রাঙ্গণে এটিই প্রথম অ্যান্থলজি ফিল্ম বা অমনিবাস চলচ্চিত্র। ১১টি ভিন্ন গল্পে ছবিটি নির্মাণ করেন ১১ জন তরুণ নির্মাতা। ঢাকা শহরে তরুণ-তরুণীদের সমসাময়িক নানা সংকট তুলে ধরা হয় এ ছবিতে। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির আগেই ছবিটি দেশের বাইরে অনেক চলচ্চিত্র উত্সবে অংশগ্রহণ করে জিতে নেয় কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তবে গল্পের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও সাধারণ দর্শকের দোরগোড়ায় সেভাবে পৌঁছতে পারেনি চলচ্চিত্রটি।

নভেম্বরে মুক্তি পায় ন ডরাই। মুক্তির আগে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন তানিম রহমান অংশু। সামাজিক, পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে একজন নারী সার্ফারের গল্প চিত্রিত করা হয় এ ছবিতে। যদিও ছবিতে মূল কাহিনী থেকে সরে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারপরও ন ডরাইকে সবার জন্য অনুপ্রেরণামূলক ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে সার্ফিং নিয়ে এর আগে দেশে কোনো ছবি নির্মিত হয়নি। ফলে এ রকম নতুন একটি বিষয় নিয়ে ছবি তৈরির পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে অন্য নির্মাতাদের জন্য উত্সাহের বলে মনে করেন অনেকে। এছাড়া দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে ছবিটির প্রচার-প্রচারণায় সংশ্লিষ্টদের চেষ্টারও কমতি ছিল না।

প্রতি বছর শাকিব খানের ছবি আলোচনায় থাকলেও, এ বছর অনেকটা অনেকটা পর্দার আড়ালেই ছিলেন কিং খান। চলতি বছর শাকিব অভিনীত চলচ্চিত্র নিয়ে খুব বেশি আলোচনা দেখা যায়নি। শাকিব অভিনীত নোলক নিয়ে মুক্তির আগে অনেক কথা হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়িকভাবে ছবিটি সুবিধা করতে পারেনি। তবে তার অভিনীত পাসওয়ার্ড- এ বছর একমাত্র ব্যবসা সফল ছবি বলে মনে করছেন অনেকেই।

চলতি বছরের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি মায়া: দ্য লস্ট মাদার। সরকারি অনুদানে নির্মিত ছবিটি ২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। কবিতা ও চিত্রকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটি নির্মাণ করে নির্মাতা মাসুদ পথিক যথারীতি তার মেধার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ ছবি ভিন্নধর্মী ও প্রথা ভাঙা ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ঢাকাই চলচ্চিত্র নির্মাণের বিদ্যমান গত্বাঁধা ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে ছবিটি। বর্তমান সময়ে একজন বীরাঙ্গনার জীবন, সংসার, তার অতীত ও যুদ্ধশিশু—এ বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিটিতে। সব মিলিয়ে চলতি বছর মুক্তিপ্রাপ্ত গল্পনির্ভর এ ছবিগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সামনের দিনগুলোয় নির্মাতা-প্রযোজক-দর্শক সর্বোপরি বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে  সামনে এগিয়ে চলতে অনুপ্রাণিত ও আশান্বিত করবে।

বিনোদন বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর